হৃদরােগে করণীয় এবং সকাল সন্ধ্যা নিয়ম করে হাঁটতে হবে

হৃদরোগ একটি ঝুঁকি পূর্ণরূপ রোগ। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে না রাখলে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে বেশি। যদিও এ রোগ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয় না কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি ওষুধ পত্র মেনে চললে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং সুস্থ জীবন যাপন করা যায়। আসুন জেনে নেই হৃদরোগ সম্পর্কিত বিস্তারিত কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর। বলেছেন: অধ্যাপক (ডাঃ) জে সি ঘােষ 

❍ প্রশ্ন: কী করে বুঝব ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ হয়েছে?
 
☛ উত্তর: ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের শুরুতে চলতে ফিরতে বা উপর-নীচ করতে বুকের মাঝখানে পাথর চাপিয়ে দেওয়ার মতাে ব্যথা হয়। দাঁড়িয়ে গেলে আবার কমে যায়। ব্যথা বুক থেকে পিঠ এবং হাতেও ছড়াতে পারে। কখনও শ্বাসকষ্ট থাকে। কখনও আবার কোনও উপসর্গই থাকে না। 

❍ প্রশ্ন: উপসর্গ না থাকলে বােগ ধরা পড়বে কীভাবে? 

☛ উত্তর: অনেকে আছে যারা বছরে একবার ডাক্তারের কাছে যান। সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করান। তাঁদের কারােব যদি এরকম উপসর্গ হীন ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ থাকে, ধরা পড়ে যাবে স্ট্রেস টেস্টের মাধ্যমে। তবে এই সংখ্যাটা তুলনামূলক ভাবে কম। এমন বেশ কিছু মানুষ আছে যাদের রােগ ধরা পড়ে খুব বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক বা অর ফলে হঠাৎ মৃত্যুব মাধ্যমে। 

❍ প্রশ্ন: তাহলে তাে নিয়মিত পরীক্ষ নিরীক্ষা করাই ভাল। 

☛ উত্তর: হ্য, করালে ভাল। তবে ১০০ কোটি মানুষকে ধরে ধরে বছরে একবার করে সব পরীক্ষা - নিরীক্ষা করানাে খুব বাস্তব সম্মত নয়। তবে যাদের হাতে অনেক মানুষের জান প্রাণ রয়েছে যেমন, পাইলট, ট্রেনের ড্রাইভার- এদের বছরে একবার পুরাে চেক আপ কবাতে হয়। 

❍ প্রশ্ন: বাকিরা তবে কী কববেন? 

☛ উত্তর: বাকিরা সাবধান হয়ে চলবেন। অনেক সময় ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ কিন্তু মাঝে মধ্যেই জানান দেয়। কিন্তু এর ব্যথাটা, যাকে আমবা অ্যানজাইনা বলি, অম্বলের ব্যথার সঙ্গে এত মিলে যায় যে, ঘনঘন হলেও অম্বলের ওষুধ, গ্যাসের ওষুধ নয়তাে ব্যথা কমা বা ঘুমের ওষুধ দিয়ে এর চিকিৎসা হয়। ফলে পরে যখন অবস্থা মারাত্মক হয়, হাসপাতাল বা নার্সিংহােম ছাড়া আর গতি থাকে না। কাজেই একই উপসর্গ যদি বারবার ঘুরে ফিরে আসে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে ভুলবেন না। বয়স ৫০ এর ওপর হলে, যদি দুটোর বেশি রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে, যেমন, উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস বা প্রজন্মগতকারণ এবং উচ্চ রক্তচাপ অথবা ধূমপানের নেশা এবং বাড়িতে কারাের হার্টের অসুখ আছে ইত্যাদি, ডাক্তারের পরামর্শমতাে একবার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। 

❍ প্রশ্ন: সব পরীক্ষা নিরীক্ষা বলতে? 

☛ উত্তর: 
(১) ওজন বাড়ছে কিনা সেটা দেখা 
(২) রক্তচাপ পরীক্ষা করা 
(৩) রক্তের কিছু পরীক্ষা যেমন, ব্লাড সুগার, লিপিড প্রােফাইল ইত্যাদি মাপা 

❍ প্রশ্ন: ই সি জি করার দরকার নেই? 

☛ উত্তর: না, ই সি জি করে তেমন লাভ নেই। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসিজিতে কোনও পরিবর্তন আসে না। অর্থাৎ বুকে ব্যথা হলে ই সি জি করে কিছু নাও বােঝা যেতে পারে। 

❍ প্রশ্ন: আর রানিং ইসিজি? 

☛ উত্তর: হ্যা, ট্রেডমিল টেস্ট অনেক সময় করতে বলা হয়। তবে এখানে কয়েকটি ব্যাপার আছে যা ডাক্তার ছাড়া অন্য কারাের বােঝার কথা নয়। ট্রেডমিল টেস্ট পজিটিভ হলেই যে সবসময় রােগ থাকবে এমন কোনও কথা নেই। আবার নেগেটিভ অথচ রােগ আছে এমনও হতে পারে। অল্পবয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে ট্রেড মিল টেস্ট পজিটিভ অথচ রােগ নেই এমন বেশ কিছু দেখা যায়। 

❍ প্রশ্ন: তবে কি ট্রেডমিল টেস্ট করে রােগ আছে কি নেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় না? 

☛ উত্তর: বলা যায়। তবে সেই সিদ্ধান্ত নেবেন বিশেষজ্ঞ। 

❍ প্রশ্ন: ২৪ ঘণ্টা ধরে যে ইসিজি করা হয়? 

☛ উত্তর: হ্যা, হলটার মনিটরিং। লুকোনাে ইস্কিমিয়া ধরার জন্য এই ইসিজি কাজে আসে। আপনি খাচ্ছেন, ঘুমােচ্ছন, চলাফেরা করছেন সে সময় হার্ট কীভাবে কাজ করছে তা এভাবে ধরা যায়। 

❍ প্রশ্ন: লুকেননা ইস্কিমিয়া থাকলে তাে আমকা প্রবল ব্যথা শুরু হতে পারে। তখন কী করব? 

☛ উত্তর: বাড়িতে সরবিট্রেট অথবা আইসরডিল জাতীয় ওষুধ এবং অ্যাসপিরিন রেখে দেবেন। ব্যথা হলে সরবিট্রেট বা আইসরভিল রাখবেন জিভের নীচে। আর একটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নেবেন। এর পরই ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। ব্যথা না কমলে সরাসরি কোনও কার্ডিয়াক সেন্টারে নিয়ে যাওয়া দরকার। কারণ হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। 

❍ প্রশ্ন: দেরি হয়ে গেলে রােগী মারা যেতে পারে? 

☛ উত্তর: হ্যা, সেরকম বড় অ্যাটাক হলে রােগী মারা যেতে পারেন। এছাড়াও সমস্যা আছে। একটি মাঝারি ধরনের হার্ট অ্যাটাকে হৃৎপিণ্ডের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কার্য ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা গেলে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। 

❍ প্রশ্ন: ৪০ এর ওপর বয়স হলে দিনে ৮০-১৬০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন খেলে নাকি হার্ট ভাল থাকে? 

☛ উত্তর: অত আগে দরকার নেই। বয়স ৫০ এর উপর হলে এবং যদি দুটো রিক্ত যার থাকে অ্যাসপিরিন খাওয়া দরকার। 

❍ প্রশ্ন: অ্যাসপিরিনে যাদের অ্যালার্জি আছে? 

☛ উত্তর: তাঁরা খাবেন টিকলােপিডিন জাতীয় ওষুধ। 

❍ প্রশ্ন: রােগ ধরা পড়ার পর কেমন হবে জীবাত্রা? 

☛ উত্তর: মােটামুটি নিয়ন্ত্রিত জীবন কাটাতে হবে। আর নিয়মিত ওষুধপত্র খেতে হবে। হার্টের রােগ ধরা পড়েছে বলে চুপচাপ বসে গেলে হবে না। সকাল এবং সন্ধে নিয়ম করে হাঁটতে হবে। ওজন বেশি থাকলে কড়া ভাবে ক্যালরি মেপে খেতে হবে। ঘি, মাখন, চিজ, দালদা মার্জেরিন, ডিমের কুসুম, পাঠার মাংস, মেটে, মাল্পে ডিম, তৈলাক্ত মাছ, ভাজাভুজি, বেশি তেল মশলাদার খাবার ইত্যাদি মােটামুটি বাদ। নিমন্ত্রণ বাড়ি বা পার্টিতে গেলে যদি লােভ সামলাননা না যায়, যাওয়া বন্ধ করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ মতাে নিয়মিত রক্তচাপ, ওজন মাপা এবং রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। বেশি রাত জাগা চলবে না। এবং উদ্বেগ অশান্তি দূরে রাখার চেষ্ট করতে হবে। 

❍ প্রশ্ন: উদ্বেগ অশাস্তি কি চাইলেই দূরে রাখা যায়? 

☛ উত্তর: কিছুটা যায় বইকি। হার্টের রােগ আছে। বেশি উদ্বেগ থেকে শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়বে, হার্টরেট বাড়বে। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলে কী করবেন? নিজে যদি মন শান্ত করতে না পারেন সাইকলােজিকাল কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে পারেন। 
❍ প্রশ্ন: হার্টের রােগ আছে। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে, এই ভাবনাটাই তাে অশান্তির জন্য যথেষ্ট। 

☛ উত্তর: সবকিছু নিয়ম কানুন মেনে চললে, ওষুধপত্র খেলে এবং ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রেখে চললে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

❍ প্রশ্ন: অনেকে বলেন গত সব ওষুধ পত্র নিয়মকানুনের ঝামেলায় না গিয়ে বাইপাস অপারেশন করিয়ে নিলে নাকি বেশি ভাল থাকা যায়? 

☛ উত্তর: এই সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারবেন না। নেকেন আপনার ডাক্তার। যদি তিনি দরকার মনে করেন হবে অপারেশন। তবে অপারেশন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। প্রচুর খরচ, শরীরের ঝক্তি এবং তারপরেও কিন্তু কিছুটা নিয়ম মেনে চলার ব্যাপার থেকে যায়। কারণ যে কারণের জন্য আপনার শরীরে রােগের সূত্রপাত হয়েছিল অপারেশনের পরও তাকে এড়াতে ওষুধপত্র এবং কিছু সাবধানতা মেনে চলতে হয়। 

❍ প্রশ্ন: আর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করালে? 

☛ উত্তর: এখানেও সেই এই একই কথা। বাইপাস হবে, না অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হবে, না রােগী ওষুধের ওপর থাকবেন, সে সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার ডাক্তার। কাজেই আপনার কাজ প্রথমে আপনার পছন্দসই ডাক্তার খুঁজে বার করা। তারপর তাঁর উপর পুরােপুরি নির্ভর করা। অনেক সময় এমনও হয় কার্ডিওলজিস্ট বললেন আঞ্জিওগ্রাফি করা দরকার। তারওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অপারেশন লাগবে কিনা। বেশ কিছু খরচের ধাক্কা। রােগী মতামতটা যাচাই করে বেড়াতে লাগলেন। অনেক সময় নষ্ট হল। রােগ আরও খানিকটা এগােল। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনাে গেল না। যাইহােক, যে কথা হচ্ছিল, কিছুক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি দরকার হতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার ৬ মাসের মধ্যে ২০-৩০ শতাংশ রােগীর আবার সমস্যা দেখা দেয়। 

❍ প্রশ্ন: অনেকে বলেন রােগ নির্ণয়ের জন্য যে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করানাে হয়, তাতে ধমনীতে খোঁচাখুঁচির ফলে চর্বি জমার হার আরও বাড়ে? 

☛ উত্তর: আমরা যখন কোনও একটা পরীক্ষা করতে বলি তার দরকার বলেই বলি। প্রতিটি ওষুধের, প্রতিটি পদ্ধতির কিছু না কিছু অসুবিধে হয়ত আছেই। কিন্তু যখন জীবন মরণের প্রশ্ন তখন অত সুক্ষ্ম জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কাজেই আর একবার গােড়ার কথা বলি, ভরসা রাখতে পারেন এমন একজন ডাক্তার খুঁজে বার করুন। তারপর তার পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url